DEHLIJ

কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য

প্রিলিউড (ছোটগল্প)


 


বিকেলের শব্দগুলো
ফানুস হয়ে আকাশে
চার নম্বর প্লাটফরম্ থেকে
আপট্রেন কমলকলির অভিমুখে
সূর্য ডোবার আগে অজস্র পাখিরা
নির্বাচনী প্রচারে---
পশ্চিমের জানালা খোলা ৷অনেক খানি লাল ছোপ --রক্ত যেনো ৷ঈজেলে একটি অসমাপ্ত ছবি
কিউবিজম্ ৷না এক্সপ্রেসনিজম ৷কমলকলি ঈজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ না বোজা না খোলা ৷
অর্ধনিমীলিত ৷ হাতে কিছুটা রং ৷প্যালেটে কিছুটা রং---
আমি ছবি টা ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলাম না ৷আমি একটা পেয়ারা গাছে হেলান দিয়ে টিয়ে পাখিদের
খুনসুটি মাপছিলাম ৷দুটো টিয়া ৷আনকোরা সবুজ ৷একে অন্যের ঠোঁঠে ঠোঁঠ এরকম সংলাপঃ
এই বাড়িটার মন ভালো নেই
এই বাড়ির মেয়েটি অনেকদিন আসে না
এই বাড়িটির আনাচে কোণাচে ভয়
এই বাড়িটির দেয়ালে বিষণ্ণ রংএর খেলা
বলতে বলতে পাখসাটে উড়ান---আমি এবার ঘরের ভেতর ছবিটির দিকে তাকালাম একটা নদী—ঘন
কালো জল উথাল পাথাল৷ নদীর উপর একটি ব্রীজ ---ব্রীজের উপর একটি ট্রেন ট্রেনটির গায়ে ছোপ
ছোপ লাল রং নাকি সূর্যাস্ত নাকি রক্ত ---আমিআকাশ না আমি এখন একটি এন্জেল আমার দুদিকে
দুটি ময়ূরপঙ্খী ডানা আমি এখন উড়তে পারি আমি এখন নদী সাগর আকাশদের কথা বুঝতে পারি ৷
এই তো কাল বিকেলে আমি নদীতে সাঁতার কাটছিলাম—একটা নীল মারমেড চুপিচুপি আমাকে হাতছানি
দিল—
কোরকী এসো না
কোথায়

নদীর জল ছিল খুব স্বচ্ছ বালু নুড়ি শামুক সে এক দারুণ কান্ড ৷
মুখ দিয়ে খানিকটা জল বের করে মারমেড আমার কানে কানে বলল
আমি একটি প্রবাল দ্বীপের রাণী
ধুর প্রবাল তো সমুদ্রে হয়
চোখের কোণে হেসে মারমেড বলল
আমি ম্যাজিক জানি ৷এখুনি এই নদীকে সমুদ্র করে দিতে পারি
যাহ্
দেখবে ? দেখতে দেখতে বড় বড় ঢেউ লোণা জল প্রবাল দ্বীপ লাল নীল কুর্শীর মেহফিলে রূপালী
সার্ডিনরা ইতস্তত স্থিরতায় পাথরভাঙা জলকেলি---দেখতে দেখতে নদী কেমন সমুদ্র----
আপাতত আমি এই শেষ হেমন্তের বিকেলে কমলকলির পাশে
কিছুটা সময়
পেরিয়ে গেছে
জীবনের সাঁকো
টলমল
পুলিশ অফিসার গোঁফের ফাঁকে হাসিটাকে জীইয়ে
ম্যাডাম আপনি এতো স্থির বিশ্বাসে কী করে বলছেন যে আপনার হাসব্যান্ড কে খুন করা হয়েছে
কমলকলির চোখ দুটো আগুন বলয়
কারণ হি ওয়াজ অ্যান একটিভিষ্ট
কারণ আমাদের বিয়েটা অসবর্ণ
কারণ হি বিলঙ্ড টু সো কলড লোয়ার ক্লাস
কারণ উই ও্যয়ার গেটিং রেগুলার থ্রেট কল
কারণ রিসেনটলি উই ও্যয়ার ব্লেসেড বাই আ্য বিউটিফুল ডটার
কারণ মাই হাসব্যান্ড ও্যয়াজ অ্যান অনেষ্ট জারণালিষ্ট
কারণ---
থামুন ৷তব সে আপ বোলতে জা রহে হ্যাঁয়

আপনি জানেন আপনি যাদের নামে মার্ডার চার্জ এনেছেন ওরা কতটা পাওয়ারফুল
কমলকলির চোয়াল শক্ত
আপনি চার্জ উইড্রো করবেন কি না
না
সকালের অনেকটা আলো কমলকলির চোখে ৷কোরকী পাথরে বসে নদী আাঁকছিল ৷
আচ্ছা মা গাছের পাতা গুলোকে আমি কেন ব্লু কালার করতে পারি না
কমলকলি সূর্যের দিকে তাকিয়েছিল
কোরকী সোনা কাল আমাকে একবার এলাহাবাদ যেতে হবে---
তোমাকে শরণ্য কাকুর বাড়ী রেখে যাব ৷দুষ্টুমি করবে না কিন্ত---
না করব না ৷তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো
ইথারে তোমার গন্ধ
শব্দ পাই
কিছু রং
নিঃসঙ্গ মৃত্যু
নকশা আাঁকে
বুঝলি কোরা তোর মার মতো লড়াকু মহিলা আমি দেখিনি ৷তোকে ও কিন্তু তোর মার মতোই হতে হবে

কেউ কী কারুর মতো হতে পারে কাকু সবাই তো নিজের মতোই হয়---তাই না
কোরা তুই এই ছোট্ট বয়সে এতো কথা শিখলি কী করে রে---
ইট ইজ আ্য হার্ড কোয়শ্চন
হুইচ উড ইউ রেসকিউ
ইয়োর মাদার ইন লো ওর
দ্যা লাস্ট টেক্সট ওব শেকসপীয়ার
অফুরন্ত সূর্যের আলোয় ভেসে যেতে যেতে শীলভদ্র কবিতা টি বলেই কোরকীর দিকেতাকালো ৷
কার কবিতা বল?

কোরকী একটি সদ্য পেড়ে আনা পেয়ারায় দাঁত বসাতে বসাতে বলল
আমি জানি না তুই বল
শীলভদ্র কোরকীর বিনুনীতে টান দিয়ে
তা জানবে কেন সারাদিন শুধু গেছোপেত্নী হয়ে ঘুরে বেড়াবে
এই গালিয়া মত দেনা মেঁ চুড়ল হুঁ??
শীলভদ্র কোরকীর বেদানা ঠোঁঠে ঠোঁঠ ছুঁইয়ে
না রে তু তো পরীহ্যাঁয় পরী
সূর্যের সব রং কমলকলির শ্রান্ত চোখে ৷আজ থেকে বারো বছর আগের সেই দিনটির কথা কোরকী
কখনোই ভুলতে পারবে না
ত্রিবেণী সঙ্গমে নৌকো চলছে কমলকলি লাল শালুমোড়া ছাই ছড়িয়ে দিল সন্ধ্যার বাতাসে কমলকলির
চোখেমুখে লাল চুম্বন সূর্যের
শরণ্য আমি পেরেছি ৷আমি দোষীদের শাস্তি দিতে পেরেছি ৷ওদের যাবজ্জীবন জেল হয়েছে ----
এই শেষ হেমন্তে একই সরলরেখায় দাঁড়িয়ে আছে একটি নেকড়ে আর লাল মণিলতা
আজন্ম টান কেটে সুতো ছিড়ে উড়ে যাচ্ছে ঘুড়ি
কোরকী আর শীলভদ্র শেষ বিকেলের ট্রেনে ঘুড়ির মতোই
লাটাই ছেড়া
কার হুইলস রোর ওভার ফ্রীওয়ে কংক্রীট
নাইট ফলস অন ডালাস,টু বিল্ডিংস শাইন আন্ডার সিকল্ মুন
মেনি বয়েস এন্ড গার্লস ইন জেল ফর দেয়ার বডিস পোয়েমস এন্ড
বিটার থটস--------
আচ্ছা গীনসবার্গ ইন্ডিয়া এসেছিলেন
হ্যাঁ কলকাতায় হাংরি পোয়েটস—
এটা ঐ বেজম্মার বেটি না?
উসকো তো রাম নাম সত্য করা দিয়া
হা লেকিন হামারা আদমিকাতো জেল ভী হো গিয়া
আৌর কুছ হি দিন রেহা হোনেওলা ই হ্যায়

আরে চৌদ্দ সাল
চিন্তামত কিজীয়ে হাম হ্যায় না কুছ করেঙ্গে-
শরাবের বোতল খুলে ষায় দেশী নয় রীতী মতো বিলায়েতী
শীলভদ্র আর কোরকী তখন নদী কিংবা ঝর্ণা---
তারপর অনেক কুয়াশা নেমেছিল অনেক বাস টার্মিনাল থেকে ভ্রমণে বেরিয়েছিল কোরকী আর
শীলভদ্র মই বেয়ে ক্রমশ উঠে যাচ্ছিল সূর্যের দিকে
কোরা এবার আমরা একসাথে চল দুই মার পারমিশন নিয়ে --
হ্যাঁ আমার ফাইন্যাল এক্সাম শেষ আর তুই চাকরি পেয়ে গেছিস --
মা আজ আমরা শহরে যাচ্ছি মুভি দেখব আর খাওয়া দাওয়া করে ফিরব
ওকে বেবি টেক কেয়ার
তুমি কিন্তু খেয়ে নিও
বাই বলে কোরকীহাওয়া কিংবা আকাশ
অনেক রেড রোজ ডিনার
অনেক আলো
অনেক স্বপ্ন –
ওরা যখন বাস স্টপে নামল রাত তখন দশটা
শরতের হালকা আকাশে কৃষ্ণ পক্ষের কাস্তে চাঁদ
লঘু বাতাসে কাশের গুচ্ছ চাঁদ আলোয় বড় মায়াময়
ওরা অপেক্ষা করছিল ৷ রেড রোজ দের আসরে হিংস্র
নেকড়ের থাবা ৷শীলভদ্র কোরকীকে আগলে রাখে মমতায়
দাঁতাল শূয়োরেরা ছিন্নভিন্ন করে গোলাপের পাঁপড়ি ---
কোরা তু ভাগ যা
নেহি ৷ হাম একসাথ লড়েঙ্গে
জিনা ভী একসাথ মরনা ভী
পড়ে থাকে দুটি থেৎলানো গোলাপ

কাস্তে চাঁদ চুমু খায়
কাশফুল ভালবাসার হাত বুলিয়ে নিরাময় করার চেষ্টা করে---
হুজুর হামনে কুছ নেহিকিয়া
হম তোআজই জেল সে নিকলে
হুজুরইয়ে অনার কিলিং কা মামলা হ্যাঁয়
কমলকলি নির্বাক
কমলকলি বুঝি বেঁচে নেই
শরণ্য সওয়াল জবাবে হেরে যায়
কুরুক্ষেত্র জুড়ে দুঃশাসনেরা হাসে
ইয়োর অনার অনারকিলিং হলে শুধু হত্যা হতো
কেন গণধর্ষণ হবে
ধর্ষণ তো হয়নি ধর্মাবতার
মেয়েটির গোপনাঙ্গে কোনো সিমেন ট্রেসেস নেই
সুতরাং প্রমাণের অভাবে তিনজন আসামী কেই মুক্তি দেওয়া হলো
দ্য কোর্ট ইজ এ্যডজারনড্ –
আমি এবার কমলকলির অসমাপ্ত ছবির সামনে
কমলকলি ঘুমিয়ে পড়েছে ৷ আমি আস্তে আমার মার কপালে চুমু
কোরা তুই বিয়ের দিন কোন রং এর বেনারসী পরবি
আগুন রং এর মা
মা তুমি ছবি গুলো শেষ করো
লাল হলুদ আর বেগুনি
জানো আমি একটি সামোভার এর গল্প জানি
সমোভারটি রাশিয়া থেকে আর্জেন্টিনা তারপর আমেরিকায় পালিয়ে যায়
আর কোনো সামোভার পালাবে না
দেখো ৷প্রমিস মম

আমি হালকা ডানায় উড়ে যাই---
সেইসব মিথ্যেগুলি বারবার আলোচনার
টেবিলে
স্বপ্ন গুলি থেৎলে যায়
তারাদের ছায়ায়
আশ্রয় নেয়
সেই কাশফুলে মিথ্যের উৎসবে সেইসব
ধর্ষকামী দের মেহফিল
আমি শরীর পাল্টাই ৷আমি তো এখন আর কোরকী নই ৷আমার দুপাশে দুই ডানা
আমিবাতাসের মতো নেমে আসি মিথ্যের মেহফিলে –
মিথ্যেগুলি ভয় পায়---
সকালের খবরের কাগজ নাগরিক ঘরে ঘরেপৌঁছে দেয় সেই খবরনামা
কোরকী ধর্ষণ এবং কোরকী শীলভদ্র ডাবল মার্ডার কেসের সদ্য খালাস প্রাপ্ত সব আসামী দের গতকাল
রাতে রহস্যজনক ভাবে সেই ধর্ষণ স্থানটিতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় –মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত – তবে
ওদের পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণে লিকারের মাত্রা পাওয়া গেছে ---অনুমান করা হচ্ছে অত্যধিক
মদ্যপানের ফলেই---ইত্যাদি –ইত্যাদি—
শীত সরে সরে যাচ্ছে প্রকৃতি ভিন্ন রূপটানে কমলকলির জানালায়
ঈজেলে দুটি মুখ পাশাপাশি
কমলকলি পর্দা সরিয়ে দেয়
সবটুকু সকাল সোনার বাটি ভরা রোদ উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে ঈজেলের ক্যানভাসে
কচি আমরুদ পাতায় শিষ দেয় দুটি বুলবুলি
বসন্তের প্রিলিউড ছড়িয়ে যাচ্ছে----

No comments

FACEBOOK COMMENT