DEHLIJ

ঝুমা চট্টোপাধায়

 রিজওয়ানুর 




যেভাবে  প্রিয়বিচ্ছেদের দৈর্ঘ্য ও  যতটা  ভালোবাসার  প্রস্থ  ও  উচ্চতায়, কিছুটা মিথ আর, উন্মুখ  জীবন যেমন  এখনও নশ্বরতার  পরেও  এগিয়ে  যাচ্ছে  … বলতে  ইচ্ছা  হয় সব  সময়  তো  দেখি  লাইভে  থাকিস  রিজ এদিকে একবার  আসতে  পারিস  তো ! এখানে  কাল  রাত্রে খুব সুন্দর জ্যোৎস্না  উঠেছিল। কাল  ছিল পৌষী –পূর্ণিমা। মূলত  মাঘ মাসের শুরু ধরা হয়, যদিও  বাংলা  ক্যালেন্ডারে  কাল দিন ছিল  বারোই  মাঘ।  দূরের  মাঠ ঘাট, ডিপিএল এর  বড়  চিমনিটা,  পাড়ার  বাড়িগুলো  আর বাড়ির  সামনের  রাস্তার  সংগমরত  কুকুর ,সবই  ঐ  দুর্দান্ত  জ্যোৎস্নায়  ভেসে যাচ্ছিল। আগেও  তো  বার কয়েক  এসেছিস  এদিকে  কিন্তু  আমার  কাছে  তেমন ভাবে আসিস নি  কখনও। হ্যাঁ  তোর  আঁতলামির  সঙ্গে  আমারটা  মেলে  না  কিন্তু  তুই  তো  জানিস  আমার  মা  অনেক দিন  ধরেই  নিখোঁজ,  সে  একুশ  বছর  তো  হলই ।  আর  এখন  ঐ  পাশের  রুমে  দরজা  বন্ধ  করে  ওয়ার্ক  ফ্রম  হোম  চলছে, একটা স্লিম ম্যাকবুক  আর  বেয়াল্লিশ  ইঞ্চির  দুটো  মনিটর  নিয়ে দুপুর  দুটো  থেকে  তারপর  মাঝরাত  অব্দি। ম্যাকবুক   শুনেছিস  তো?  ম্যাকবুক  প্রো?  এসব  শুনতে  কি  খুব  ডিসগাস্টিং  লাগছে  তোর ?  দ্যাখ   এসব  বাংলায়  আর  বলা   চলে  না,  কারণ   বাংলায়  বললে ঠিক  যুগোপযোগী  হয় না। আমি  অবশ্য  এখনও  যা  লিখি,  যতটা  লিখি  বাংলাতেই  লিখি। কিন্তু  লিখলেও  মূলত  আমি  একা, কাজেই  আমার  দুঃখটা  এখনও  খুব  খাঁটি  ঐ পৌষী –পূর্ণিমার  মতই।  বলছিলাম  তাই  যদি  আসতিস  একবার।  কারণ  পিসীমা  তো  একবার  করে  আসেই  আমার  এখানে।  বড়  থলিতে  চাবির  গোছা, কিলো  খানেক  নরম  রসগোল্লা আর নিজের  জমির  ভাল  গোবিন্দভোগ  চাল।  বুঝছিস  তো  আমি  তো  আর  তেমন  যেয়ে  উঠতে  পারিনা  পিসিমার  কাছে  , আর  যাবটাই  বা  কখন? বাংলা  লিটিল  ম্যাগাজীন গুলোর  অবস্থাটা  দেখেছিস ?  করোনা  পরিস্থিতির  কারণে  বইমেলা  তো  বন্ধ  কিন্তু  ব্যক্তিগত  উদ্যোগে  কোথাও  কোথাও  লিটিল  ম্যাগাজীন  মেলা  করবে  বলছে।  সফট্ কপিতে  কার্ড  ছাপিয়েছে  সব  দেখলাম।  মানে  ঐ  ফেসবুক, ইন্সটা, ওয়া – এসবে  ।  তাতে  কেউ  ডাক  পেয়েছে  কেউ  পায়নি। দ্যাখ  রিজবানুর  তোকে  যেমন  আমার  সাতজন্মের  কথা  শেয়ার  করেছি  তেমন  এটাও। আমি  তো  সারা  জীবনটা  লিটিল ম্যাগাজীনে  লিখে  চলেছি। এখানে  এভাবে  লিখতেই  বেশি  ভাল  লাগে।  আর   লিখতে  গেলেই  তুই  তো  জানিস  ভাষাটা  নিয়েই  বেশি  ভাবি। নির্ভার, লঘুপক্ষ, চিত্ররূপময়, ও  কাব্যধর্মী  এক  ভাষা  যাতে  লৌ্কিক  আঢপৌঢ়ে  শব্দের  সাথে  ব্যবহৃত  হচ্ছে  অজস্র  তৎসম  ও  তদ্ভব  শব্দ। ফলত  ভাষাটা  হয়ে  দাঁড়াচ্ছে  একই  সঙ্গে লালিত্য  ও  শক্তির  এক  যুগপৎ  আধার। বক্তব্যের  ভার ভাষার ভারকে  ছাপিয়ে  উঠছেনা। অনেকটা  ঐ  পিসীমার  আনা  ভালো  চালের মত।  ভাতটা  খাচ্ছি  ঠিকই  কিন্তু   ভাতের  সুগন্ধটাই  যেন পুরোটা  জুড়ে  রয়েছে। উদারণ  একটা  দ্যাখ  তুই- ‘ রূপার  বোন নতুন কাপড়  পরে  দ্যাকাতে  এসেচে, তার  হাসিমুখে  যেন  হলুদের  ডুগুডুগু। পরশু  গায়ে হলুদ, তরশু  বিয়ে। সারা  উঠোনটা  জুড়ে  ম্যারাপ  বাঁদা চলচে, বর  আসবে  যখন, শুনচি  নাকি  তোপ  পড়বে –‘ এমনি  করেই  কথা বলত  মা। পুরনো  গল্প  কথা  তো  হামেশাই  হত  তখন । দ্যাখ  রিজ  এই  তোদের  মতন  যারা  সিঁড়ির  চাতালে  দাঁড়িয়ে  আছিস  তো  ফোন  টয়লেট  যচ্ছিস  তো  ফোন  তাদের  মনে  এসব একদম  দাগ  কাটবে না ।  মায়ের  মুখের  ঐ  বাংলা  শব্দগুলো  আজো  কি  ভিষণ  আমাকে  ঝাঁকিয়ে দেয়…… তুই  এসব  বুঝবিই  না।  রোজ  সকালে  ঘুম  থেকে জেগে গঙ্গা –পদ্মার  মত  বহতা  নদী  দেখবার জন্য প্রাণটা হাঁকুপাকু  করে, ফরোওয়ার্ড  মেসেজ নয়।  মেসেজের  ঐ  বাঁদিকের  কোণায়  যে  ঝাপসা মত  ফরোওয়ার্ড  ছাপাটা  থাকে ( পাড়ার  ঐ  কুকুরদের মত  লাগে ), জাস্ট  এইজন্য না রিজ  আমি  তোকে  হোয়্যাটসঅ্যপে  রাখিইনি।  
কিন্তু  এই  বাজারে  নেট ওয়ার্কিং  এ  না  থাকলে  কি  করে  চলে  বল?  নেট দুনিয়ার  কল্যাণেই  তো  জানতে পেরে  গেলাম  চার  বছরের  খুদে  কানাডা  থেকে  পঞ্জবে  তার  ঠাকুমাকে  কালা কানুনের  বিরুদ্ধে  সোচ্চার  হতে  উৎসাহ  যোগাচ্ছে। পাঁচ লাখের  ওপরে  লাইক  আর সোওয়া তিন লাখ  কমেন্ট  বাগিয়ে  খুদেটি   এখন  হিরো- ওয়ার্ক  ফ্রম  হোম! চাষী, জনতা, জনসাধারণ, মন্ত্রী, ক্যাবিনেট মিনিস্টার, গৃহমন্ত্রী – সবই ও সবাইই  গণ এর । এই গণ ঠিক কি চায় আর কি চায় না ভগবানও  জানে না। মনে হয় গণ ‘তুলনা’ চায়। অনেক ভেবেচিন্তে আমি এটাই ভেবেছি।
যোগীজী  বলছে- মোগলরা  আমাদের  আদর্শ  হতে  পারেনা। বাঃ রে হিন্দুস্তান! দু হাজার  সতেরোয় সুভাষের ফাইল তো  মন্ত্রী খোলার  নির্দেশ দিয়েছিল কিন্তু  শেষ  অব্দি  কি হল এখনও কেউ জানতে পারলাম না। নেতাজী  সুভাষ চন্দ্র বোস। মানুষটার যে সত্যি সত্যি কি হল কে জানে? দেশে চাকরি নেই। হস্পিটালে  ডাক্তারের কমি। ভাববার  অনেক বিষয়। আমলাতন্ত্র জন সাধারনকে  ভাববার জন্য অগাধ সময় ও সাবজেক্ট দুইই সাপ্লাই করে দিচ্ছে বুঝলি!
মাগরীবের  নমাজ এর  শব্দ নাকি  সুপ্রিম কোর্ট  বন্ধ  করে দিতে  বলছে না কি  একটা  শুনলাম যেন। হিন্দু  রাষ্ট্র  হবে  নাকি  ঠিক! যা  হবে  হোক ! ওসব  ইতিহাস  ফিতিহাস  যেমন  চলে  এসেছে  চলুক! আমার  কি?
তুই  একবার  আসিস  রিজবানুর বুঝলি? দাসী-বাঁদি, লাঠি-লাদনা, মেজাজ-মর্জি ,   শব্দ গুলো  খেয়াল  করে  দ্যাখ , তৎসম  আরবী দেশী সব মিলে মিশে  কেমন  তৈরী আর  প্রত্যেকটার  বুৎপত্তিগত  অর্থও  কেমন এক।  যেমন  দাসীও যা  বাঁদীও তাই , দাসী  বাংলা শব্দ  বাঁদী  আরবী  শব্দ। লাঠির  অর্থ যা লাদনাও  তাই। অথচ  উচ্চারন  করবার  সময়    এই  দুইই  শব্দই  একইসাথে উচ্চারিত হয়ে এসেছে। এই রকম  কত  শব্দ  যে আমরা দীর্ঘকাল  চলতি বাংলায় ব্যবহার  করে এসেছি…… কেউ  কি  এর  দিশা  দিতে  পারবে? ভাষার  বাহকেরা  সব খড়া বজার  মে…  ময়মনসিংহ গীতিকার  লেখক ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনকে  মনে আছে? বাংলার  প্রাচীন সাহিত্যের  তিনি বহু মনি-মানিক্যের সন্ধান দিয়ে গিয়েছেন। কত বছর  তো চলে গেছে  কিন্তু  আজও  তাঁর মত সাহিত্যের ইতিহাস  কেউ আর লিখে উঠতে  পারল না। পল্লি  কবি  জসীমউদ্দীন  যখন ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ গ্রন্থটি  লেখেন , তৎকালীন  আনন্দবাজারের  সম্পাদক  সত্যেন্দ্র মজুমদার  এর নিন্দে করে ফেলেছিল। বলেছিল,  জসীম উদ্দীনের  এই  কবিতায়  সাম্প্রদায়িকতা  আছে।  ভাষাবিদ  সুনীতিকুমার  চট্টোপাধ্যায়ও  ঐ একই  মতামত  প্রকাশ করেছিলেন। উত্তর  দিয়েছিলেন দীনেশবাবু, বলেছিলেন ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটে’ কিছু আরবী-পার্শী শব্দ ব্যবহার করা  হয়েছে, এটাই  তো স্বাভাবিক।  ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যেও বহু  আরবী-পার্শী প্রয়োগ  আছে।  তাহলে  সেটাও তো সাম্প্রদায়িক । আরও  বলেছিলেন দীনেশবাবু- আমি  হিন্দু, বেদ পুরাণ  আমার  নিকট অতি পবিত্র। কিন্তু ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট ‘ তার থেকেও  পবিত্র  কারন  এই  গ্রন্থে আমার  বাংলাদেশের  মাটির মানুষ গুলির  কথা  লিখিত  হইয়াছে ……’’  
একটা  লিটিল  ম্যগাজীনে  লিখব  ভেবেছিলাম এগুলো তা  সম্পাদক  বলছে , তিনি  নাকি  আর  বেশিদিন বাঁচবেন না। মরে  যাবেন  তাড়াতাড়ি। এগুলো  এক রকমের ঢং না? এসব ক্যালানে সম্পাদক রা  পাখির ডাককেও  থ্রেট মনে করে বুঝলি!
সবাই কি  মা ? না সুভাষ ? যেমন ভাববে ঠিক তেমনই  করবে?



No comments

FACEBOOK COMMENT