DEHLIJ

শিবু মণ্ডল

 রাজনীতি 




 

আমাদের সংসারে আমরা ঘরে-বাইরে দুইজন। যেন একটি দেশের দুটি রাজনৈতিক দল। ক্ষমতা ভোগের তরে সর্বদা হট্টগোল। একে অন্যের দিকে আঙুল তুলে বলি কে ধান্দাবাজ, আর কে ছদ্মবেশী। কাদা ছোঁড়াছুড়ি চলে ঝগড়া পর্যন্ত। চলে তুমুল গালাগালি। হাতাহাতি। চিতা থেকে তুলে আনি একে অন্যের অতিত ইতিহাস! আমাদের সন্তান দুটি পর্দার আড়াল থেকে দেখে বিস্ময় চোখে। আমাদের দলাদলিতে সন্তানেরা দিশেহারা, ক্ষুধা পেটে চিল্লাচিল্লি করে, করে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি। আমরা দুজন যে যার পক্ষ নিয়ে ঘর ভাগ করি। তারপর রাত্রি হলে ভোগ ও লালসা তাড়িত আমরা এক সন্ধি স্থাপন করি। আমাদের সন্তানেরা তখন গভীর ঘুমে ডুবে আছে স্বপ্নে!     

 

ডিম ফুটছে জলে স্থলে, আমাদের অন্তঃস্থলে


বঁড়শিতে টোপের মতো গেঁথে নিয়ে এক বৃদ্ধ কখনো এখানে কখনো ওখানে ডুবিয়ে রাখছে আমার ঋজু মেরুদণ্ডকে। একটি ফোটকা মাছ তার অন্ধলস্কর নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সাঁতরে যায়, একটু একটু ঠুকরায়। খেয়ে নেয় আমার লোহিত কণিকার সৃষ্টি-সাহস, সাদা ক্যালসিয়ামের সততা।

বঁড়শিগাঁথা আমার মেরুদণ্ডটিকে কখনো কচুরিপানায় ঢাকা অন্ধজলে ডুবিয়ে রাখছে। আবার কখনো মরীচিকার তীব্র বিদ্বেষে ঝলসে দিচ্ছে। মাঝের দূরত্বে কালো কালো তীক্ষ্ণ মাথা নিয়ে জেগে আছে দমনপুর।

ডিম ফুটছে জলে স্থলে, আমাদের অন্তঃস্থলে! ঘুমের আস্তরণ ভেদ করে অনুকূল নগ্নতা ভোরের দিকে এগিয়ে যায়। সুজাতা মাছ ও বৃদ্ধের অপেক্ষায় আছে পায়েসের বাটি হাতে...

শেষে যদি জিজ্ঞেস করো আমায়- এগুলো কী? আমি বলবো এগুলো একটা স্বপ্ন; যে স্বপ্ন আমি মুছে দিতে পারছি না।    

 

 

বিপদ


বিপদ আমাদের এক শরিক দাদুর নাম। দেশভাগের লাভ যদি আমাদের বংশের কেউ পেয়ে থাকে তবে সে। সব ভাইকে বিপদ বিপদ বলে সিমান্তে পাচার করে সবার ভাগের জমি বেচে দিয়েছিলো। তারপর বিপদ বিপদ বলে সেও বদলেছিল দেশ। দেশ বদলে সে হল জমির দালাল! বিপদ দাদুর বাড়িতে একটি কাঁচা কুয়া ছিল। ছোটবেলায় আমরা ঝুঁকি নিয়ে ঝুঁকে সেই কুয়ার জলে যার যার মুখ দেখতাম। সেই দাদু এখন নাই। দাদুর ছেলে আছে। দাদুর ছেলে দাদুর থেকেও বড় এক দালাল। বাড়িটি পরিত্যাক্ত। কুয়াটি এখনো আছে। তবে তার দিকে তাকালে আর নিজেদের মুখ দেখতে পাইনা। বদলে নতুন একটি রাষ্ট্রের ছবি দেখতে পাই। দেখতে পাই তাতে লাশ পড়ে আছে। যতরকম মানুষের লাশ হতে পারে সব ! শুনি বিপদ দাদুও নাকি মরে যাবার আগে তার সমস্ত পাপের দলিল এই কুয়াতেই ফেলে দিয়েছিলো। তারপর ঝাঁপ দিয়েছিলো এই কুয়াতে! পাড়াপড়শিরা বিপদ বিপদ বলে এগিয়ে গিয়েছিলো কুয়ার দিকে।

এত পুরানো একটি ঘটনা মনে করতে গিয়ে এখন বুঝতে পারছি না, আসলে বিপদটা কে সেই দাদু নাকি কুয়াটি!      

 

অনুকূল হুঙ্কার


এই তো সুযোগ্য সময়, এবারের শীতলতাকে জয় করবার। ফিরে দেখা নিজের কুশলতা। কুয়াশার আত্মনির্ভরশীলতা। নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে তুলে ধরা। বহুদিন হয়ে গেল নিজেকে আর বাজি রাখি না বিপ্লবে কি প্রেমে। সোমত্ত মিথ্যায় জর্জরিত আমার চতুর্থ স্তম্ভ। প্রতিকূল হাত থেকে খসে পড়ে সব প্রাপ্তি। প্রতিবাদ রাখবার কণ্ঠ পাচ্ছি না। হাড়হিম শীতের রাত কামড়ে পড়ে থাকা শ্রমিকের দল, কৃষকের বউ, জুয়াড়ির ক্যাশবাক্স, শিশুর গ্যাসবেলুন সেতু পারাপারের পরেও একটা অনুকূল ঠাকুর খুঁজে পেল না। স্মৃতিতে তাদের চোখ ঢুলু ঢুলু, যাত্রাপালার হুঙ্কার, পুতুল নাচের ইতিকথা। ভোরের অপেক্ষায় মাথায় তাদের কুয়াশার ধর্মহীনতা, জাতীহীনতা, গোত্রহীনতা ভর করে। এই তো সুযোগ, এই তো মঞ্চ প্রস্তুত, কাঁসরের শব্দে, ঢোলকের বোলে একটা অনুকূল হুঙ্কারের।

 

 


1 comment:

  1. বিপদ ও অনুকূল হুংকার - অনবদ্য লাগলো

    ReplyDelete

FACEBOOK COMMENT