DEHLIJ

অমিতাভ মৈত্র

আমাদের স্বর্গ নেই, স্যারিডনও নেই

 

অমিতাভ মৈত্র


Through me you pass into the city of woe :
Through me you pass into eternal pain :
Through me among the people lost for aye.
Before me things create were none, save things
Eternal, and eternal I endure.
All hope abandon, ye who enter here"
- Inferno. Canto-III
                               
                             "The Divine Comedy"
                    Dante Alighieri

‘আমারই ভেতর দিয়ে গেছে অনন্ত যন্ত্রণার পথ। আমারই ভেতর দিয়ে গেছে হারিয়ে যাওয়া মৃত মানুষদের পথ। কোনাে বস্তুই আমার আগে সৃষ্টি হয়নি শুধু অনন্ত ছাড়া। এবং অনন্তের শেষপ্রান্তে এই আমিই। সমস্ত আশা পরিত্যাগ করে এই রাস্তায় আসবে তুমি।”


পথপ্রদর্শক ভার্জিল নরকের দরজায় লেখা কথাগুলি পড়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন দান্তেকে। বলছেন, এখানে তুমি দেখতে পাবে সেই সব হতভাগ্য আত্মাদের যারা চিরদিনের মতাে তাদের শুভবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে। যারা জীবনে কোনাে নিন্দা বা প্রশংসা পায়নি, যারা বিদ্রোহ করেনি আবার বিশ্বস্ত থাকতেও পারেনি। শুধু বিশ্বস্ত থেকেছে নিজের স্বার্থের প্রতি। পদাঘাতে স্বর্গ ফিরিয়ে দিয়েছে এই স্বার্থ সর্বস্ব আত্মাদের। এমনকি নরক পর্যন্ত এদের স্থান দেয়না, কারণ তাদের পাপের প্রাবল্যে নরকেও ছড়িয়ে যাবে লােভ, লণ্ঠন, সম্পদ লিপ্সা। দান্তে তখন পথপ্রদর্শক ভার্জিলকে প্রশ্ন করলেন "Master! What doth aggrieve them thus, that they Lament so coud?" উত্তরে ভার্জিল বললেন


"That will I tell, thee briefly. These of death
No hope may entertain : and their blind life
So meanly passes, that all other lots
They envy. Fame of them the world hath none,
Nor suffers; mercy and justice scorn them both.
Speak not of them, but look, and pass them by." 

 

বাংলায় এভাবে বলা যায় : “এককথায় আমি উত্তর দেব এই প্রশ্নের। অন্ধ ও হীন এই জীবনগুলি ঈর্ষায় জ্বলে যায়, কিন্তু মৃত্যু হয়না এদের কখনও। করুণা আর বিচার ঘৃণা করে দূর করে দেয় এদের। না বলাই ভাল এদের কথা। তাকিয়ে দেখে নাও একবার। তারপর চলাে।”

 

(2)


দান্তে ছিলেন নরকের দর্শকমাত্র। তিনি চলে যেতে পারতেন। কিন্তু আমরা যারা অনুদ্ধারণীয়ভাবে থাকতে বাধ্য হই তারা জানি এই নরক – আমাদের অস্তিত্বে জড়িয়ে আছে। সকালে কাগজওয়ালা বারান্দায় নতুন নরক নামিয়ে দিয়ে যায় রােজ আর চায়ের কাপ নিয়ে আমরা ঝুঁকে পড়ি সেই নরকে। পড়ি দিল্লি মান্ডাবলী গ্রামে অনাহারে ধুকতে ধুকতে আয়েস করে, রেলিশ করে মরে যাওয়া মানসী (৮), পারুল (৪) ও শিক্ষা (২)র খবর। ওদের মা ছিল মানসিক ভারসাম্যহীন। সে জানত না বাচ্চারা পাঁচ-ছয় দিন এক দালাও কিছু খায়নি। বাচ্চারা একবার বমি করেছিল বলে খাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তাদের। আর তাদের মা ভুলে যায় তার তিনটি শিশু এক অপরিচিত হৃদয়হীন পৃথিবীতে নিঃশব্দে মুছে দিচ্ছে নিজেদের অদ্ভুত আনন্দিত মুখে, হাসতে হাসতে, হাত নাড়তে নাড়তে। দেড়শাে কোটি মানুষের বিপুল রঙ্গমঞ্চ এই দেশ, গায়ে গা ঘেঁষে যেখানে চলে যাচ্ছে অনর্গল মানুষ নিরুদ্বেগ পপকর্ণ খেতে খেতে। কেউ কিছু জানেনা। কিছু দেখেনা। নরকের নিয়ম এরকম। দশ দিন আগে মরা কুকুর কি তার পাশে শুয়ে একইসাথে পচে যেতে থাকা বেড়ালের কথা জানে? এক অসীম দূরত্বের দেশ! অন্ধ মানুষ, নিজের মাংসের সুখের সন্ধানে ছুটে বেড়ানাে মানুষ, পরজীবী মানুষ – এলিয়টের ‘ফায়ার সারমন” (ওয়েস্টল্যান্ড) অংশটির শেষ লাইনগুলি যাদের মাথায় আগুন জ্বেলে দেবেনা কখনাে। যারা বলবেন
 

Burning bruning burning burning

O Lord thou pluckest me out 

O Lord thou pluckest Burning
 

(3)

ঝােপের ভেতর থেকে আসা কান্নার শব্দ শুনে পথচারিরা ভেবেছিলেন কোনাে কুকুর-বেড়ালের ছানা হয়তাে। 

কয়েকঘণ্টার পরে কেউ কেউ অনুসন্ধিৎসু হয়ে ঝােপে উঁকি মেরে দেখেন সদ্যোজাত একটা কন্যা শিশু পড়ে আছে সেখানে আর কয়েকশাে পিপড়ে, মশা, মাছি, পােকামাকড়ের রক্তপান উৎসব শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে পরিশ্রমী। পিঁপড়েরা এর মধ্যেই সম্পূর্ণ খেয়ে ফেলেছে তার চোখ দুটো।


খবরটা ছড়িয়ে পড়ে এবং এক সময় খোঁজ পাওয়া যায় শিশুটি একজন টোটো চালকের কন্যা। ওই দম্পতির তিন ছেলে আর এক মেয়ে আছে। এই সন্তানটিকে সে ঈশ্বরের হাতে রেখে দিতে চায়।
ঝােপের মধ্যের সেই অর্ধভুক্ত শিশুটি সম্ভবত সানন্দেই মারা গেছে এটা জেনে যে তার নরকবাসের জীবন অনেক দূর পর্যন্ত প্রলম্বিত হল না আর। শিশুটির সারা শরীরে থিকথিক করা পিপড়ে আর মশার মতাে আমরাও ঝেড়ে ফেলব শিশুটিকে আমাদের স্মৃতি থেকে এবং অপেক্ষা করবাে নতুন কোনাে উত্তেজনার জন্য। খবরের কাগজ বিক্রেতা, নিউজ চ্যানেল, বুদ্ধির চাপে হাঁটু ফুলে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের বিশ্লেষণে ঢুকে যাব। আর এইসব মৃত দেহগুলাে এভাবেই হয়তাে তাদের ভাষা পেয়ে যাবে কখনও। "And what the dead had no speech for, when living they can tell you being dead." ("Little Gidding" - T.S. Eliot)

(৪)
নয় বছরের মেয়েটিকে তার সৎ মা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তার ১৪ বছরের ছেলে আর তার বন্ধুদের দিয়ে গণধর্ষণ করিয়েছিল। প্রায় পনেরাে দিন ধরে নিখোঁজ মেয়েটির জন্য তার বাবা মিসিং ডায়েরি করে থানায়। কয়েকদিন পরে বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে জঙ্গলের মধ্যে পুলিশ মেয়েটির পচাগলা শরীর খুঁজে পায়। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে যে দ্বিতীয় বিবাহের জন্য স্বামীর ওপর রাগে সে নিজে দাঁড়িয়ে ধর্ষণ করায় মেটিকে এবং ধর্ষণের পর নিজের হাতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মেয়েটিকে মেরে ফেলে তার সৎ মা। মেয়েটির ধর্ষক সভাই তখন মাথায় কুড়ুল মেড়ে ঘিলু ছড়িয়ে দিচ্ছে মাটিতে আর তার এক বন্ধু ছুরি দিয়ে চোখ উপনে নিচ্ছে তার। এরপর মেয়েটির সারাগায়ে অ্যাসিড ঢেলে ঝােপের মধ্যে মৃতদেহটিকে ফেলে চল গিয়েছে তারা।


মাত্র দুদিনের খবরের কাগজ থেকে ঘটনাগুলাে পড়া। কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা এরা নয়। কোনাে নরকের কথাও নয় এ সব। নরক আমাদের স্বপ্নের দেশ, স্বর্গ। জীবন সেখানে নিশ্চয়ই এতাে ভয়ঙ্কর নয়। আমরা ঢাক পিটিয়ে বােঝাতে চাই আসলে আমরা খুব মহৎ, ঈশ্বরের আদলে তৈরী। নিজেদের আড়াল করতে আমরা কাল্পনিক এক অজুহাত বের করি। নরক আমাদের সেই অজুহাত। পচগলা মাংস নিয়ে সােরগােলের কিছু নেই। এই মাংস আমাদের অসহ্য নয়। বরং আরধ্য। কিন্তু মাংসাশী প্রাণীরা আমাদের মাংস ঘৃণা ও ভয়ে এড়িয়ে যায়। সত্যিকারের নরক হয়ে উঠলে আমাদের এই দেশের কল্যাণ হতাে।

 

 

6 comments:

  1. মানুষের মতো এতো এতো ঘৃণ্য জীবই বা আর কে। সত্যি সত্যি যদি নরক হতো। তাহলে বোধহয় এসব রক্তক্ষরণ থেকে আমরা মুক্তি পেতাম।

    ReplyDelete
  2. দেখছি কল্পনার নরক আর বাস্তব নরকের ফারাক।

    ReplyDelete
  3. সাংঘাতিক লেখা, এটা "বিশাখা নক্ষত্রের রাত্রি" কাব্যগ্রন্থে পড়ে বিমূঢ় হয়েছি!

    ReplyDelete
  4. সাংঘাতিক লেখা, এটা "বিশাখা নক্ষত্রের রাত্রি" কাব্যগ্রন্থে পড়ে বিমূঢ় হয়েছি!

    ReplyDelete
  5. লেখাটা পড়ে চুপ করে বসে থাকতে হয় , এতো অসামান্য !! আপনার গদ্য ও কবিতা দুটোই আমার কাছে অপরিহার্য ,অমিতাভ-দা

    ReplyDelete
  6. আদ্যোপান্ত এক স্পিশিস

    ReplyDelete

FACEBOOK COMMENT