অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়
স্বপ্নের শেষ দৃশ্য
বিয়ে বাড়ির সামিয়ানা । হ্যালোজেন আর টুনি বাল্বের আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক যেন দিনের সূর্যকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে । সামিয়ানার ঠিক দোরগোড়ায় বর্শা হাতে দুই সান্ত্রি দূর্গ পাহারা দেওয়ার কায়দায় দন্ডায়মান । তাঁরা পূর্ব শর্ত অনুযায়ী নিয়ম মাফিক কাজ করে চলেছে । সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই দু’জনে একসঙ্গে বর্শা দুটো সরিয়ে নিয়ে নিমন্ত্রিতদের ভেতরে প্রবেশ করার পথ করে দিচ্ছে । ওদের দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন কলের পুতুল ।
চোখ ধাঁধানো বাতিটা হাতের তালুর সাহায্যে আড়াল করে সন্তোষবাবু ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছিলেন । সামিয়ানার কাছাকাছি পৌঁছতেই হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা অর্পণের সঙ্গে । বহুদিন পরে দেখা দু’জনার । মুখোমুখি হতেই একে অন্যের দিকে হতবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সন্তোষবাবু আনন্দের আতিশয্যে চিৎকার করে বলে ওঠেন – আরে অর্পণ যে ! কি ব্যাপার ? কোথায় থাকো আজকাল ? তোমাকে আজকাল কোথাও দেখাই যায় না । এখানে তোমার সাথে যে আমার দেখা হবে তা ভাবতেই পারিনি । একটু নীরবতা পালনের পর তিনি জানতে চাইলেন – তারপর বল তুমি কন্যাপক্ষ না বরপক্ষ ?
অর্পণ হেসে জবাবদিহি করে এই বলে – নিঃসন্দেহে আমি কন্যাপক্ষ । আমার পাড়ার মেয়ে । বৌভাতের নিমন্ত্রন রক্ষা করতে এসেছি ।
সন্তোষবাবু রসিকতা করে বলেন – তুমি হলে কন্যাপক্ষ আর আমি হলাম বরপক্ষ । সুতরাং বুঝতেই পাচ্ছ আমি তোমার চেয়ে উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি । তুমি যখন কন্যাপক্ষ তাহলে বাইরে না দাঁড়িয়ে চল ভেতরে ঢোকা যাক । আজকের দিনে তুমি আমাদের অতিথি । ভীষণ ঠান্ডা বাইরে । এখানে একাকী ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থেকে অন্যমনস্ক হয়ে কি দেখছিলে এতক্ষণ যাবৎ ?
কথাটা মিথ্যে নয় । অর্পণ অনেকক্ষণ যাবৎ অবাক বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে কি যেন নিরিক্ষণ করছিল । দু’চোখ ভরে যা কিছু দেখছিল তাতেই ঘোর লেগে যাচ্ছিল তাঁর । বারংবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল । কেবলই মনে হচ্ছিল ঠিক একই রকম পরিবেশে সে এর আগে অন্য কোথাও উপস্থিত ছিল । সেদিনের পরিবেশটা তাঁর কাছে বহু পরিচিত বলে মনে হচ্ছিল । সে অবাক হচ্ছিল এই ভেবে যে হঠাৎ কি ভাবে সে জাতিস্মর হয়ে উঠলো ? কিন্তু জাতিস্মরেরা তো পূর্বজন্মের স্মৃতি নিয়েই জন্ম গ্রহণ করে । এতদিন পরে মানস পটে কি তাহলে পূর্বজন্মের কথা ভেসে উঠছে ? সেই মুহূর্তে তাঁর আর অন্য কিছু মনে পড়ছিল না । মনে মনে ভাবে তাহলে কি স্বপ্নে কখনো দেখেছিল এই দৃশ্য ! এক সময় নিজেকেই সে সান্ত্বনা দিয়ে বলে – বোধহয় তাই হবে । স্বপ্নেই দেখে থাকবে হয়তো ।
সন্তোষবাবু তাঁকে পুনর্বার তাড়া দিয়ে বলেন – কি দেখছো তখন থেকে ঘুড়ে ঘুড়ে ? আমি তো দেখার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না । চল ভেতরে চল । দিল্লী শহরে এরকম লাখ টাকার প্যান্ডেল তুমি অনেক দেখেছো এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই । এখানে ঠান্ডার মধ্যে না দাঁড়িয়ে তারচেয়ে বরং ভেতরে গিয়ে দাঁড়াই চল ।
অর্পণ প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞাসা করে – আমি কি দেখছি ? দেখছি আমার স্বপ্নে দেখা এক চলমান দৃশ্যপটের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি । অর্পণ আগের মতোই অবাক দৃষ্টিতে প্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে – আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, এখানে দাঁড়িয়ে আমি কিন্তু একমাত্র আপনার কথাই চিন্তা করছিলাম । আমার মন বলছিল আপনি আসবেন । আপনাকে আসতেই হবে যে করেই হোক । জানি না এরই নাম টেলিপ্যাথী কিনা ! আপনি যে হঠাৎ আমার মুখোমুখি হবেন এটা কিন্তু আমি প্রতি মুহুর্তে আশা করছিলাম । আশ্চর্যের বিষয়, মনে মনে যা ভাবছিলাম সেটাই হয়েছে । আপনার কাছে আমার উপস্থিতি অপ্রত্যাশিত হলেও, আমার কাছে কিন্তু আপনার উপস্থিতি খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা । আপনার আশার অপেক্ষায় আমি উন্মুখ হয়ে ছিলাম । আমি ছোটবেলা থেকেই হৈ-হট্টগোলের চরম বিরোধী সেই কারণে লোকে আমাকে অসামাজিক বলতে দ্বিধা করে না । কথাটা একবার ভেবে দেখুন, মেয়ে আমার পাশের বাড়ির প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও ওর বিয়েতে আমি যাইনি । অথচ মজার কথা এই যে, আজ মেয়েটির শ্বশুর মহাশয় আমার বাবাকে বৌভাতে আসার নিমন্ত্রন করতেই আমি এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম । আমি কিন্তু কোন অনুষ্ঠান বাড়ি যাই না । আরো মজার কথা এই যে, মেয়ের বাড়ির লোকেরা বৌভাতে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের যোগদান করার জন্যে বাসের ব্যবস্থা করেছিলেন । আমাকে ওরা দলের সঙ্গে বাসে করে আসতে অনুরোধ করেছিলেন । আমি তাদের সঙ্গে দল বেঁধে আসতে অস্বীকার করেছিলাম । ওদের বলেছিলাম, নাসিরপুর খুব দূরে নয় আমি হেটেই চলে যেতে পারবো । আমার জন্যে চিন্তা করবেন না । তারপর আমি একাই হেটে চলে এসেছি এতটা পথ । এখন আমার নিজের কাছেই ব্যাপারটা কি রকম অদ্ভুত লাগছে । এখন ভাবছি কেন এলাম ? না এলেই হতো । আসার আগে একবারের জন্যেও কিন্তু মনে হয়নি যাব না । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কেউ হয়তো আমাকে জোর করে এখানে টেনে এনেছে । নইলে এরকম হওয়ার তো কথা নয় ।
সন্তোষবাবু অর্পণের কথায় সায় দিয়ে বলেন – এরকম হয় কখনো কখনো । ইচ্ছের বিরুদ্ধে এবং মনের তাগিদ না থাকলেও অনেক সময় কাজটা আমাদের করতে হয় ।
- আমি স্বীকার করছি আপনার কথা । কিন্তু আমার জীবনে আজকের দিনের ঘটনাগুলো সব অন্য রকম । এর পেছনে আমি সঠিক কোন যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না । একটু থেমে অর্পণ আরো বলে – আমি প্রমান করে দেব যে আমার সেদিনের দেখা স্বপ্নের সাথে আজকের ঘটনাগুলোর কতটা সাযুজ্য । ভেতরে ঢুকলেই দেখবেন টেণ্ট হাউসের ভাড়া করা তিন-চারটি একুশ-বাইশ বছরের তরুনী সকলকে স্ন্যাক্স পরিবেশন করছে । তাদের পরনে কালো রঙের শাড়ি । তাঁদের মাঝ পিঠ অবধি সাবানে ফাঁপানো খোলা চুল । কপালে গাঢ়ো লাল রঙের টিপ । দেখবেন আমরা ভেতরে প্রবেশ করে একটু এগিয়ে যাওয়া মাত্র একটি মেয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে আমাদের স্ন্যাক্স খাওয়ার জন্যে অনুরোধ জানাবে । আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে যেই প্রশ্ন করবো – আজকের এই শুভ সন্ধ্যায় তোমার অঙ্গে কালো পোষাক কেন ? আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন যে, মেয়েটি একগাল হেঁসে আমার প্রশ্নের জবাবদিহি করবে এই বলে – অশুভ রঙের বিপরিত হলো লাল সেই কারণে কপালে লাল টিপ এঁকেছি ।
সন্তোষবাবু অতিশয় উত্তেজিত হয়ে বলেন – এবার ভেতরে চল । তোমার কথার সত্যতা যাচাই করা যাক । গিয়ে পরখ করা যাক তোমার দেখা স্বপ্নের সাথে বাস্তবের কতটা মিল ?
সিংহ দরজা দিয়ে প্রবেশ করে একটু এগিয়ে যেতেই অর্পণের কথা অনুযায়ী ত্রস্তপায়ে একটি মেয়ে কাছে এগিয়ে আসে । সামিয়ানার বাইরে দাঁড়িয়ে অর্পণ মেয়েটির সম্বন্ধে যা কিছু ভবিষ্যৎ বানী করেছিল তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়ে যায় । অমাবশ্যার অন্ধকারের চেয়েও ঘণ কালো রঙের শাড়ি পরা মেয়েটির কপালে জ্বলজ্বল করছিল সিঁদুর রাঙা লাল টিপ ।
অর্পণ প্রশ্ন করতেই সন্তোষবাবুকে চমকে দিয়ে মেয়েটি অর্পণের বলা মুখের কথাটাই সে জুড়ে দেয় । সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি । সন্তোষবাবু হতবাক দৃষ্টিতে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন । তিনি এক কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় । কি বলবেন ভেবে পান না । কথাটা উচ্চারণ করা মাত্র তাঁর শ্বাসরোধ হয়ে গিয়েছিল । তারপর অর্পণ আর সন্তোষবাবু দু’জনেই দু’জনার মুখের দিকে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে । নিথর নিস্পন্দ কারোর মুখে কোন কথা ছিল না । কিছুক্ষণের জন্যে দু’জনেই নির্বাক ।
সন্তোষবাবু এক সময় নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলেন - খুব আশ্চর্য ব্যাপার তো ! একটু কি যেন চিন্তা করে তিনি অর্পণকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করেন – এরপর কি ঘটেছিল বলতে পার ?
অর্পণ সেই সময় অন্যমনস্ক হয়ে আপন মনে নিজের কথা ভাবছিল । তারপর সন্তোষবাবুর অপার কৌতূহল মেটানোর উদ্দেশ্যে তাঁর জীবনে আগাম ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বিবৃত করছিল – আজকের দিনের মতো সেই দিনটিও ছিল শনিবার । শনিবারে আমি আমিষ আহার করি না । সেদিন বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রিতদের মধ্যে তিনজন আমিষ না-খাওয়ার ব্যাপারে আমাকে উপহাস করেছিলেন । খানা-পিনার ব্যাপারে আমার সেকেলের মতো আচার-বিচার আছে জেনে তাঁরা রীতিমতো বিস্মিত বোধ করে ধিক্কার দিয়েছিলেন ।
সন্তোষবাবু উৎসুক হয়ে অর্পণের কথাগুলো শুনছিলেন । আর মনে মনে ভাবছিলেন – এই জন্যই কি শেক্সপীয়ার সাহেব বলেছিলেন – পৃথিবীতে অনেক অজানা রহস্য গা ঢাকা দিয়ে আছে যা দর্শন সাস্ত্রের ব্যাখ্যার অতীত । দুনিয়ায় এরচেয়ে বড় আর কি আশ্চর্যের ঘটনা থাকতে পারে ? অর্পণের কথা তিনি যতই শুনছিলেন ততই রোমাঞ্চিত হচ্ছিলেন । মনে হচ্ছিল তিনি যেন রুপালী পর্দায় কোন চলচ্চিত্র দেখছেন । পরের দৃশ্যটা দেখার জন্যে তাঁর মনের ভেতর অবদমিত উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছিল ।
সন্তোষবাবু ভেতরে এগিয়ে যাওয়ার অবসরে হঠাৎ বলে ওঠেন – বয়স হলো সত্তরের ঘরে । রাত্রিবেলায় আজকাল বড় একটা চোখে দেখি না । আমার আসাটা শুধুমাত্র নিয়ম রক্ষা পালনের জন্যে । নইলে ছেলের বাপ আমায় গালাগাল দিতে ছাড়বে না । এক কালে অফিসে দুজনে একসঙ্গে আমরা কাজ করেছি । সে আমার বন্ধু স্থানীয় । সে যাই হোক, তোমায় আমি আগে থেকে বলে রাখছি আমায় একা ফেলে তুমি যেন কোথাও চলে যেও না । আমাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব তোমাকে দিলাম । পরক্ষণে একটু রসিকতা করে বললেন – অর্থাৎ হাতে তুলে আমাকে খাওয়াতে হবে না । খাবারগুলো আমার প্লেটে তুলে দিলেই হবে । কোনটা খাই না খাই তা চিনতে পারবো না । আজকের দিনে তুমি তো আবার আমিষ খাও না । তাই আমার প্লেটে তুলে দিতে তোমার কোন আপত্তি নেই তো ? ছোঁয়া খাও তো ? নাকি তাও খাও না ? এই ব্যাপারে তোমার কোন অসুবিধে থাকলে তাহলে আমি তোমায় জোর করবো না ।
অর্পণ তাঁকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে বলে – আপনি চিন্তা করবেন না । আপনাকে তুলে দিয়ে আমি হাত ধূঁয়ে নেব । তাছাড়া আজকের রাতটা আমি আপনার কাছাকাছিই থাকবো । তারপর খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে গেলে এমনিতেই আমরা ছাড়াছাড়ি হয়ে যাব । তখন কে কার ? সব একাকার ।
সন্তোষবাবুর কৌতূহলাদ্দীপক প্রশ্ন – আচ্ছা, সেদিন স্বপ্নে তুমি আর কি কি দেখেছিলে ? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে ।
অর্পণ উত্তরে জানায় – ধারাবাহিক হিসেবে বলা সম্ভব নয় ।একটু থেমে সে বলে – তবে টুকরো দুই-একটা ছবি যেগুলো এখনো ধূলোর আস্তরণে ঢাকা না পড়ে মনের আঙ্গিনায় জীবন্ত হয়ে আছে সেগুলো ইতিমধ্যে সবই প্রায় বলা হয়ে গিয়েছে । নতুন করে আমার আর কিছু বলার অবশিষ্ট আছে কিনা ভেবে পাচ্ছি না ।
সন্তোষবাবু উত্তেজিত স্বরে বলেন – তোমার স্বপ্নের শেষ দৃশ্যটা কি ছিল আমি সেটাই বিশেষ ভাবে জানতে চাই । ওটার উপরেই নির্ভর করছে সবকিছু ।
অর্পণ প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞাসা করেন- কেন আপনি গল্প লিখবেন নাকি ? শুনেছি গল্পকারেরা কোন ঘটনার পরিনতির কথা ভেবেই গল্প রচনা করেন । আপনিও কি তাই ভাবছেন নাকি ?
- কি যে বল এই সত্তর বছর বয়সে আমি লিখবো গল্প ? এই বয়সে ভীমরতি হয় তা স্বীকার করি কিন্তু নতুন করে গল্প লেখক কবি বা সাহিত্যিক হওয়া যায় না । যারা হতে চান তাঁরা বামন হয়ে সুদূরের চাঁদ ধরার বৃথা আশা করেন তাঁদের কপালে ব্যর্থতা ব্যতীত অন্য কিছু জোটে না এটুকু বলতে পারি । লেখার অভ্যেস একটা বদ অভ্যেস । আমি বাপু কোন অভ্যেসের দাস নই । তবে তুমি যাই বল গল্প লেখার মতোই প্লট বটে । তুমি তো এখনো গল্প লেখ । তুমি একদিন নিজের মুখেই বলেছিলে গল্প লেখার অভ্যেসটা তোমার ছেলেবেলার । তোমার লেখা গল্প আমি মাঝে মধ্যে লিটিল ম্যাগাজিনে দেখি । তুমি লিখছো না কেন ?
- কি যে বলেন কাকাবাবু আমি লিখবো নিজের গল্প ? অর্পণের সংক্ষিপ্ত জবাব ।
- কেন ক্ষতি কি ? সন্তোষবাবু আরো জানান – শ্রীকান্ত উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজের কথাই লিপিবদ্ধ করেছেন । তিনি ছাড়াও এরকম আরো অনেকেই করেছেন ।
- আপনি উপহাস করছেন না তো ? অর্পণ মন্তব্য প্রকাশ করে এই বলে – উনি হলেন বাংলার মনীষী । যা উনি পেরেছেন তা কি অন্য সকলের দ্বারা সম্ভব ? অন্ততঃ আমার দ্বারা অসম্ভব । তারচেয়ে আমার কথা অন্য কেউ লিখলে বেশি উপভোগ্য হবে লেখাটা ।
- একদিক থেকে তুমি ঠিকই বলেছো । এই কারণেই গল্পকারেরা নিজের অভিজ্ঞতার কথা এবং অন্তর্নিহিত ভাবগুলো সব অন্যের মুখ দিয়ে ব্যক্ত করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন বেশি । নিজেকে আড়াল করে রাখার মধ্যেই তাঁরা বেশি তৃপ্তি ও আনন্দ পান ।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সন্তোষবাবু বলেন – আর দেরি কেন ? চল, খাবারটা খেয়ে নেওয়া যাক । ন’টা বেজে গিয়েছে ।
তাঁরা দু’জনেই এগিয়ে যান খাবার রাখা টেবিলের দিকে । প্লেটে খাওয়ার সাজিয়ে নিয়ে একটি জন বিরল জায়গায় দাঁড়িয়ে দু’জনেই যখন রাতের আহার করতে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তে এককালীন স্কুলের সহপাঠী অনুপের সঙ্গে হঠাৎ দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যায় । সে কাছে এগিয়ে এসে অর্পণের প্লেটের উপর নজর দিতেই অবিশ্বাস্য ভঙ্গীতে বলে ওঠে – সে কি রে ! বিয়ে বাড়িতে এসেও কৃচ্ছ্রসাধন ! বাঙালি হয়েছিস কিন্তু মানুষ হোলি নে । বাঙালির পরিচয় ভোজন রসিক হিসেবে । সেই সন্মানটাকে তোর হাতে খুন হতে দেখে আমি খুবই দুঃখিত । অন্যদের দেখেও তো শেখা যায় । আর কোথাও না যাস অন্ততঃ আমাকে অনুসরণ কর । দেখ তো আমার প্লেটখানা কি সুন্দর সাজানো !
এমন সময় অতিথি সেবায় ব্যস্ত স্বয়ং ছেলের পিতৃদেব এসে হাজির সেই স্থানে । অনুপের মুখ নিঃসৃত উপদেশাবলী তিনি হয়তো শুনে ফেলেছিলেন । তাই ওর মুখের কথাটা শেষ হতেই তার সঙ্গে নিজের অভিমত যোগ করে বললেন – শেখার জন্যে আর কারো কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই । সন্মুখেই সশরীরে দন্ডায়মান স্বয়ং গুরুদেব বালুসাই মুখার্জী ওরফে শ্রী সন্তোষ মুখার্জী । এনার কীর্তিকলাপের কথা তোমাদের কারোরই জানা নেই । এনাকে আর কেউ চিনুক না চিনুক আমি চিনি । ইনি একজন মহান গুপ্তযোগী । এনাকে সকাল সন্ধ্যায় প্রনাম করা উচিত । তারপর একটু কি ভেবে নিয়ে সন্তোষবাবুর অনুমতি ভিক্ষে করে জিজ্ঞাসা করলেন – সন্তোষবাবু পোল খুলবো নাকি ? এই প্রজন্মের অনেকেই আপনাকে চেনে না । আপনার সাথে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই । তাতে কোন আপত্তি আছে আপনার ?
সন্তোষবাবু মিচকি হেসে মন্তব্য করলেন – আপত্তি কিছু নেই । তবে দেবব্রতবাবু জীবনের অপরাহ্ন বেলায় পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে কী লাভ ?
দেবব্রতবাবু উৎসাহিত হয়ে পঞ্চমুখে বন্ধুর গুণকীর্তন করতে লাগলেন – আজ থেকে বিশ বছর আগে স্বয়ং ডি.এ.জি.-র সাথে বাজি ধরে জল বিহীন আশিটা বাসি বালুসাই গলাদ্ধকরণ করা কি সোজা কথা ? এখানেই শেষ নয়, তারপর এক খিলি সুগন্ধিত জর্দা দেওয়া পান, তাও ডি.এ.জি.-র পয়সায় । ইনি হলেন সেই মহাজন যার সাথে তুলনীয় রাজা রামমোহন রায়, একটা গোটা পাঁঠার মাংস খাওয়া তাঁর কাছে এমন কিছু কঠিন কাজ ছিল না । আর দ্বিতীয় জন হলেন আধ মনই কৈলাস, আধ মন চিড়ে সহযোগে যিনি প্রাতরাশ করতেন । আমাদের সন্তোষবাবু হলেন তাঁদের সমগোত্রীয় । বিদেশের মাটিতে জন্ম নিলে এতদিনে তাঁর নামে স্মারক তৈরী হতো । আজকের এই বৃদ্ধ একদিন ইতিহাস রচনা করেছিলেন । প্রমাণ করে দিয়েছিলেন বাঙালি আর যাই হোক না কেন ভীরু নয় ।
এরপর অর্পণের দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেছিলেন – বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রন রক্ষা করতে এসে তুমি নিরামিষ খাচ্ছ ? তাও আবার ইতিহাস শ্রষ্ঠা এই মহান ব্যক্তির সামনে দাঁড়িয়ে ? তোমার শরীর টিকবে কি করে ? প্লেটে তো কিছুই নেই দেখছি !
দেবব্রতবাবু সেখান থেকে বিদায় নিতেই সন্তোষবাবুর কৌতূহলী প্রশ্ন – তোমার খাওয়া নিয়ে পরিহাস করার ব্যাপারে দু’জনকে চিনলাম । কিন্তু তৃতীয়জন কে ?
অর্পণ জবাবদিহি করে এই বলে – সে আর কেউ নয় আপনি স্বয়ং । আমাকে পরিহাস করার প্রথম ব্যক্তি । মনে নেই আপনিই তো হাসতে হাসতে বলেছিলেন - ছোঁয়া খাও তো ? নাকি তাও খাও না ? এরই মধ্যে বেমালুম ভুলে গেলেন কথাটা ?
সন্তোষবাবু লজ্জিত হয়ে বলেন – ছিঃ আমার কথায় তুমি কিছু মনে করো না । আমি না জেনে তোমায় ব্যথা দিয়েছি । যা বলেছি তা পরিহাস ছিল না । বলেছি নিছক কথাচ্ছলে । এই ব্যাপারে আমি ভীষণ লজ্জিত ।
অর্পণ তাঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলে – মনে করবো কেন ? এগুলো তো আজকের দিনে আমার প্রাপ্য ।
সন্তোষবাবু অধৈর্য হয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন – যাক্ তোমার কথায় আমি মনে শান্তি পেলাম । তুমি তোমার স্বপ্ন প্রসঙ্গে এতাবৎ যা কিছু বলেছো প্রত্যেকটি কথা সবই অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে । তবে আমি তোমার স্বপ্নের শেষটুকু জানতে না পারা পর্যন্ত স্বস্তি পাবো না । বিষয়টা ভীষণ অদ্ভুত লাগছে আমার বিচারে । আশা করি শেষটা আরো বেশি রোমাঞ্চকর হওয়া উচিত । একটু থেমে তিনি মন্তব্য করেন – কথায় বলে, ‘যার শেষ ভালো তার সব ভালো’; আবার ‘শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর’ নামেও একটি কথা আছে; আবার সঙ্গীত জগতের ক্ষেত্রেও সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি ‘ওস্তাদের মার শেষ রাতে’ । এমন কি কবিগুরুর রচিত একখানি উপন্যাস আছে যার নাম ‘শেষের কবিতা’ । তাই আমার শেষটুকু জানার ইচ্ছে হচ্ছে । স্বপ্ন যে কখনো সত্যি হতে পারে তা কল্পনাতীত । কবিরা অবশ্য কাব্য করে বলেন ‘স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়’ । কিন্তু মানুষের জীবনে এর কোন মূল্য আছে বলে আমি মনে করি না । তুমি ভালো করে একাগ্রচিত্তে মনঃসংযোগ করে একবার ভেবে দেখ তো যে স্বপ্নের শেষটা কি ছিল ?
সন্তোষবাবু যতই শেষটুকু জানার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন, উত্তেজিত ও কৌততূহলী হয়ে উঠছিলেন অর্পণকে ততই ম্লান ও বিষন্ন লাগছিল দেখতে । ভারাক্রান্ত মনে পলকহীন দৃষ্টিতে অস্ফুট স্বরে অর্পণ এক সময় বলে ওঠে – শেষটুকু আর নাই বা শুনলেন । ক্ষতি কি ? শেষটুকু না হয় আমার মধ্যেই চাপা থাক । আমি না হয় এখন থেকে আপনার পরামর্শ অনুযায়ী বাংলার কথাশিল্পীর মতো নিজের কথা দিয়েই গল্প লিখতে আরম্ভ করবো । যেদিন শেষ করতে পারবো সেদিন সর্বপ্রথম আমি নিজে এসে আপনাকে শোনাবো সেই গল্প । ধারাবাহিক উপন্যাসের শেষে যেমন লেখা থাকে ক্রমশঃ প্রকাশ্য । ধরে নিন এটাও অনেকটা সেই রকম । তবে এইটুকু বলতে দ্বিধা নেই যে, স্বপ্ন যে কখনো কখনো সত্যি প্রমানিত হয় তাতে কোন সন্দেহ নেই ।
সন্তোষবাবু ক্ষুণ্ণ মনে বললেন – তোমার যখন বলতে আপত্তি আছে তাহলে থাক । তোমাকে জোর করবো না । তবে মনে রেখো এক মাঘে শীত যায় না । তোমাকে আমি মাঝেমধ্যেই শেষটুকু জানার জন্যে বিরক্ত করবো ।
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকে যাওয়ার পর আর কিছুই করনীয় থাকে না, একমাত্র স্বস্থানে ফিরে যাওয়া ছাড়া । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অর্পণ এক সময় অনুমতি চায় – আমি তাহলে রওনা দেই কেমন ?
সন্তোষবাবু জানতে চান – তুমি ফিরবে কি ভাবে ?
- কেন ? যেমন এসেছিলাম ঠিক তেমনি ভাবে । অর্পণের সংক্ষিপ্ত জবাব ।
- রাতের বেলায় এত দূরে তুমি একা একা যাবে ? সন্তোষবাবু পরামর্শ দেন – তারচেয়ে একসঙ্গে বাসে গেলেই পারতে । ওরা সকলেই তো তোমার চেনা । এতে তোমার লজ্জা কিসের ?
- যখন ওরা ডেকেছিল তখন আসিনি । তাই এখন ওদের সাহায্য নেওয়াটা কোনমতেই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না । তারপর একটু নীরবতা পালনের পর অর্পণ সান্ত্বনা দিয়ে বলে - আপনি আমার জন্যে একটুও চিন্তা করবেন না । কাল ভোরবেলায় আপনি ঘুম থেকে ওঠার পরেই আপনাকে আমার দেখা স্বপ্নের শেষ দৃশ্যের খবরটুকু জানাবো । দেখবেন কী রোমাঞ্চকর সেই খবর ! আমি জানি আপনি ভীষণ উতলা হয়ে আছেন । শুধু মাত্র রাতটুকু আপনি অপেক্ষা করুন । নমস্কার কাকাবাবু । এবার আমি তাহলে চলি কেমন ?
# # #
শীতের দিনের সকাল । তখনো ভালো করে সূর্য ওঠেনি । কুয়াশা ভরা মেঘলা আকাশ । ফোনটা হঠাৎ কর্কশ শব্দে সকলকে সচকিত করে তোলে । রিসিভারটা হাতে না তোলা পর্যন্ত রেহাই নেই । ক্রমাগত বেজেই যাবে । একেবারেই সহবত শূন্য, কান্ডজ্ঞান হীন । তাই একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদর করে হাতে নিতে হয় সে যতই অবাধ্য হোক না কেন ।
সন্তোষবাবুর হঠাৎ অর্পণের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল । ভোর বেলায় তাঁর স্বপ্নের শেষ দৃশ্যের খবরটুকু জানানোর কথা ছিল । সে নয় তো ? যদিও এত ভোরে সেই খবর পরিবেশন করার কি প্রয়োজন ছিল ? কাল রাত্রেই সে জানাতে পারতো । অর্পণ কি এমন রোমাঞ্চকর খবর জানাতে ইচ্ছুক ?
- হ্যাঁলো । সন্তোষবাবুর কণ্ঠস্বর ভেসে ওঠে ওপারে ।
- কাকাবাবু আমি নাসিরপুর থেকে সুদীপ বলছি ।
- হ্যাঁ বল । এত ভোরে হঠাৎ ফোন করলে যে ? সন্তোষবাবু জানতে চান - কি ব্যাপার ?
সুদীপ ওপার থেকে বলে ওঠে - আমার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী সুমিতার পাশের বাড়ির প্রতিবেশী যার সাথে গতকাল রাত্রে আপনি সারাক্ষণ গল্প করছিলেন সেই ছেলেটি মারা গেছে বাড়ি ফেরার সময় ।
- অর্পণ মারা গেছে ? কি বলছো তুমি ? সন্তোষবাবু বিশ্বাস করতে পাচ্ছিলেন না কথাটা । বেহালায় ছড় টানার মতো এক করুন ব্যথা সমস্ত অন্তর জুড়ে হাহাকার তুলছিল । ভাষাহীন বেদনায় শরীরটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছিল নিজেকে কিছুক্ষনের জন্যে সামলে নিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেন – কি ভাবে ?
- সড়ক দুর্ঘটনায় । গাড়ির ধাক্কায় । সুদীপ আরো জানায় – ভেবেছিলাম রাত্রেই জানাবো খবরটা কিন্তু জানাইনি এই কারণে যে, আপনি অসুস্থ রাতে আপনার ঠিক মতো ঘুম হয় না তাই ঘুমের ব্যাঘাত করতে চাইনি । আমি রাখলাম এই মুহূর্তে একটু ব্যস্ত আছি । পরে কথা হবে ।
আরো কিছু তথ্য সংগ্রহের আগ্রহে মনটা ছটফট করছিল সন্তোষবাবুর । কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়ে সুদীপ তার আগেই ফোনটা রেখে দেয় ।
সন্তোষবাবু রিসিভার ধরে রাখার শক্তিটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিলেন । রিসিভারটা হাত থেকে খসে মাটিতে পড়ে যায় । তিনি চেয়ারে বসে পড়েন । নিজের অজান্তে আপন মনে বলে ওঠেন – স্বপ্নের শেষ দৃশ্যটা হয়তো ওর আগে থেকেই জানা ছিল ! সেই কারণেই হয়তো ও আমাকে ক্রমশঃ প্রকাশ্য বলে বারংবার সাময়িক সান্ত্বনা দিচ্ছিল কিন্তু খবরটা যে এতটা মর্মন্তুদ হবে তা ভাবা যায়নি ।
Post a Comment