মণিরত্ন মুখোপাধ্যায়
ভিজে গামছা
ভিজে
গামছা নিয়ে এত কাণ্ড হতে পারে আমার জানা ছিলনা। অবশ্য তখন জানা থাকলে
আজকে এই বৃত্তান্ত লিখবার সুযোগও হতনা। সুতরাং সব জিনিসের মধ্যেই একটা
পজ়িটিভ পয়েন্ট থাকে। সেটিকে চিনে জেনে আলোচনা করেই না কত আনন্দ। তার
মধ্যে যদি সুনেদা পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে ছয়মাস বিছানার প্লাষ্টার বেঁধে
পড়ে থাকে তাতে আমার কী দোষ। আমি তো তাঁকে বলিনি যে ভাল করে ভিজে গামছাটা
মেলতে গিয়ে রাস্তায় পড়ে যাও দোতলা থেকে।
এই হল গিয়ে মুস্কিল। আগেরটা আগে না বলে পরের কথাটা আগে বলে দিলাম আমি। আমার এই রোগটা আজও গেলনা। তবে নতুন করে প্রথম থেকেই বলা যাক।
সুনেদার
ভাল নাম শ্রী সুনীত কুমার রায়, ডাকনাম সুনে, আমরা সুনেদা বলেই ডাকি। তিনি
খুব ভাল লোক। এখন ভাল লোক বলতে কী বোঝায় তা আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করবেননা।
তখনকার দিনে, মানে যখন আমরা ছোট ছোট ছিলাম, তখন সুনেদা আমাদের কাছে দাদার
মতই ছিলেন, চাকরি বাকরি করতেন, আমাদের সঙ্গে সমান ভাবে ভিড়ে যেতেন সরস্বতী
পুজোর ক’টা দিন। আমাদের সব ব্যাপারেই তাঁর উৎসাহ ছিল অসীম। কেবল তাঁর
একটাই দুর্বলতা, সেটা ছিল গামছা নিয়ে। সুনেদা অফিস থেকে ফিরে
পাতকুয়োতলায় হুড়ুস হুড়ুস করে গুনে গুনে দশ বালতি জল ঢেলে গামছা দিয়ে
গা মুছতেন। শব্দটা পাড়াখানটি লোক শুনতে পেত।
ঝন-ঝন-ঝনাৎ
করে বালতি পড়ার শব্দ, কপিকলের ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তারপরেই হুড়ুস করে জল
ঢালার শব্দ, না শুনে উপায় ছিলনা কারো। তার সঙ্গে সুনেদার গালাগালি করার
শব্দ ছিল একস্ট্রা, অনেকটা সিনেমার ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজ়িকের মত। কাকে যে অত
গাল দিতেন আমাদের ধারণা ছিলনা। মনেহয় ফিসের সেদিনকার যার যার চা এনে
দিয়েছিলেন কিংবা ফাই ফরমাস খেটে দিয়েছিলেন তাদের মুণ্ডপাত করতেন। সুনেদা
একটা অফিসের চাপরাশির চাকরি করতেন।
গামছা কাচা আর
গামছা মেলা ছাড়া সুনেদার আর কোন বাতিক ছিলনা। আরও একটি মুদ্রাদোষ ছিল তা
সেটা এমন কিছু নয়। সেটা হল এক কথাকে বার বার কপচানো। সুনেদা বলতেই থাকতেন
‘আমাদের চাকরি করতে হয়’ ‘আমাদের চাকরি করতে হয়’ ‘আমাদের চাকরি করতে হয়’।
তা সে অমন চাকরি তো অনেককেই করতে হয়, তাতে দোষের কী আছে। তা নয়, কথাটা
আর কাউকে নয় নিজেকেই শোনাতেন। যেন চাকরি করাটা মহা পাপের কাজ। অমন পাপ
করতে যেন কাউকে না হয়। সুতরাং সুনেদার মত ভাল লোকের চাকরি থেকে ফিরে, একটু
আধটু নয়, বেশি করে চান করা মাফ করাই যেতে পারে। আর তার সঙ্গে কিছুটা বকবক
করাও তেমন কিছু আহামরি দোষের ব্যাপার নয় যে তাই নিয়ে আমাদের কপালে
চিন্তার ভাঁজ ফেলতে হবে।
তবে হ্যাঁ, এরপর যে গামছা
কাচা নিয়ে আদিখ্যেতা, সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা করতেই হয়। ঝাড়া দশ
বালতির জলে চান করার পর আরও দশ বালতি লাগে তাঁর গামছা কাচতে। সে লাগুকগে,
দশ কেন পনের কী কুড়ি বালতির জলে কাচুন না গামছা সুনীতদা, তাতে কার কী এসে
গেল? খরচ হোক জল। জল ভগবানের দেওয়া, পয়সা লাগেনা তাতে। তবে সময় নিশ্চয়
লাগে, তা সেটা সুনীতদার হাতে প্রচুর আছে। সময় খরচ করতেও পয়সা লাগেনা।
সুতরাং সুনীতদা যে ফটাস ফটাস করে বালতির পর বালতির জলে গামছা কাচেন তাতে
কারও কোনো কষ্ট হবার কথা নয়। তার সঙ্গে বকবক করতেও খরচ হয়না কিছু। তবে কী
শীত কী গ্রীষ্ম তাঁর সেই ভর সন্ধ্যতে চান করাটা আনেকের কাছে অসহ্য লাগত
কেবল এই কারণে যে ছেলেটার অসুখ বিসুখ না করে যায়। সুনীতদার যতদিন বিয়ে না
হয়েছিল ততদিন সবাই তাঁকে ছেলেদের দলেই রেখেছিল। আমাদের সঙ্গে সমানে ভিড়ে
যেত কীনা?
এদিকে গামছা বেচারার দশা কী হত আমাদের
জানা ছিলনা। তবে একথা ঠিক যে সুনেদার পছন্দ মত সবুজ রঙের চেকচেক গামছা মাসে
কম করে একটা তো লাগতোই। অত জোরে জোরে তাকে চটকালে তার আর দোষ কী? গামছা
অতি অবোধ অবলা প্রাণী। সে কথা বলতে পারেনা। আমার লাগছে বলতে পারেনা।
এবার
গামছা মেলতে সুনেদা দোতলার বারান্দায় উঠল। বারান্দার রেলিংএর ওপর তার
বাঁধা আছে, তাতে গামছাটা মেলতে হবে। টান টান করে মেলা চাই। এটা আমরা বাইরে
রাস্তা থেকে দেখতে পেতাম। তারটা উঁচুতে, সুনেদা হাত বাড়িয়ে তার ওপর
গামছাটা মেলে দিলেন। তার পরে সেটাকে টান টান করার প্রক্রিয়া চলল। এখানেই
সুনেদার কৃতিত্ব। নিখুঁত করে গামছা মেলার পরেও পছন্দ হলনা তাঁর, আবার
সেটাকে টেনে নামিয়ে ফটাস্ ফটাস্ বার সাতেক শব্দ করে ঝেড়ে ঝুড়ে আবার তারে
মেলার কাজটি চলল। আমার মনেহয় বারবার সেই কাজটি শেষ হবার আগেই গামছাটা
হয়ত শুকিয়ে যেত। অন্তত গরমকালে তো নিশ্চয়ই যেত। শীতকালের কথা আলাদা।
তবে
সেই কসরত না দেখলে আন্দাজ করা মুস্কিল। আমার এত এলেম নেই যে লিখে বুঝিয়ে
দেব সেই কাজটার নিঁখুতত্ব। কিংবা তার রিস্ক এনালিসিস করে দেব এমন কথাও বলতে
পারিনা। এবং এমনি করেই ঝুঁকে গামছা মেলতে গিয়ে একদিন সুনেদা পড়ে গেলেন
রাস্তার দিকে, তাঁর কোমর ভেঙে গেল। প্লাষ্টার করিয়ে এসে বিছানায় পড়ে
রইলেন ছয়মাস।
অনেক আগেই সুনেদার কোমর ভাঙা উচিত
ছিল। এটা আমার কথা নয়, আমাদের সবার কথা। অতগুলো গামছার মৃত্যুর কারণ ছিলেন
তিনি, অভিশাপ লেগেছিল তাঁর। গামছা হলেও তারাও তো একরকমের প্রাণী। তাদের
শরীরেও ব্যথা লাগতে পারে, যন্ত্রণা হতে পারে। তারাও সুনেদার অফিসের
কেরানিবাবুদের মত হুকুম করতে পারে – এই সুনে, একটা চা নিয়ে আয় দেখি। আজ
এত জলকাচা খেয়েছি যে সারা শরীরে ব্যথা হয়েছে।
কিন্তু
সে সব আমরা জানিনা, আর জানিনা বলেই গামছাদের দুঃখের কথা বুঝিনা এমন কথা
বলবনা। তা বললে অন্যায় করা হবে। এখন এটি সুনেদার কথা না গামছাদের কথা তা
আমকে বলতে বলবেন না।
Post a Comment