DEHLIJ

শুভ্র বন্দোপাধ্যায়

 অসাড়লিপি


 

২০

আবিষ্কার করে নিচ্ছি বেরনোর ইচ্ছেগুলোকে কীভাবে ঘিরে নিচ্ছে আলোর গরাদ
জল গিলে ফেঁপে থাকা অব্যবহৃত নৌকার কাঠ

আবিষ্কার করে নিচ্ছি অসাড়ের দীর্ঘ সাদা ছায়া আমাদের যাবতীয় কর্ষিত খেতে – ফসলই বিস্মৃতি –  যখন বিস্মৃতিকেও ঘিরে ধরে অসাড়ের গনগনে রেখা –  যখন স্মরণ একমাত্র গরম ছাইয়ের স্তূপ তখন কোথায় যায় আমাদের প্রাচীন কবিতাগুলো? যখন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা স্মৃতিতে তুলে নিয়েছিলেন স্থানীয়তা? স্থান-স্থানিক-স্থানাঙ্ক –  আমাদের গণিত না শেখা মাথায় তুলে নিয়েছি মানচিত্র –  স্বর ফোটাবার প্রতীক যাকে চেহারা বদলাতে দেখল ভাষা –  সে তো কখনও রাজার ছিল না!

আমি ডুবিয়ে নিচ্ছি জোনাকির উত্তাপে সেঁকা অক্ষর, রক্তে মিশে থাকছে আহ্বানের ব্যর্থ আঁচড় –  আর কোনও দেশ নেই, কোনও ভাষাগত সংস্কার নেই –  ভয়ের দেয়ালের ছাই উড়ে আসছে এই পাতায়, আমি ফুঁ দিয়ে ওড়াতে চাইছি গমন!

শব্দগুলো ভেঙে দিচ্ছি। 'জাগ্রত' থেকে তুলে নিচ্ছি 'জাত', 'সময়' থেকে 'সয়' –  যে চাষি নিজের জিভ চিবিয়ে খেল তার জন্য 'লাঙল' থেকে পুনর্বার বের করে আনলাম 'লাল', অথচ বাজারের কিছুই বদলানো গেল না, যেমনটাবা গেল গেল না সহিংস আক্রমণের সম্ভাবনা –  আমি পরপর বিদেশি বন্ধুদের ইমেইল পড়তে লাগলাম। মেহিকো থেকে দাবিদ উয়ের্তা পাঠিয়েছেন সে দেশের হিংসার কারণ-মানচিত্র > আমি মেসো-আমেরিকার ভূগোল পড়াতে গিয়ে দেখছি কীভাবে কৈশোর অস্ত্র তুলে নিচ্ছে > চোখের সামনে স্থির পশ্চিম উত্তর প্রদেশের ম্যাপ, হরিয়ানা, রাজস্থান> আর জল লেগে ফেঁপে ওঠা কাঠের মত বাংলা>     আমার প্রতিটা শব্দ পাথুরে পথে ঘোড়ার খুরের শব্দ, আমার প্রতিটা রাস্তার মোড়ে নিৎশে ঘোড়াদের কাছে ক্ষমা চাইছেন, আমার কবিতার বন্ধুরা বলছে ধর্ষণের কথা কবিতায় লেখা যাবে না

আর কোনও সংস্কার নেই! কবিতাকে এবার রোলার কোস্টার করে তুলতে হবে (যেমন বলেন নিকানোর পাররা), মৃগীরোগীর মুখে যেমন খেঁচুনির সময় গুঁজে দিতে হয় জিভ না কামড়ানোর চামচ, তেমনই কবিতায় ঢুকবে না লেখার জিনিস। অজানা = ভয়; মেনে নিলে হবে না!



কীভাবে মাত্র দু'শো বছর আগের সর্বকাজের ভাষা আমাদের দেশ থেকে উবে গেল? ক্ষমতার ভাষাই শেষ কথা



কবিতাকে হিঁচড়ে নিয়ে যাবো দিল্লির ত্রিলোকপুরির বিধবা পাড়ায়



কল্পনালতার গায়ে বিছিয়ে দাও নাটকীয়তার কাঁটাতার> গায়ের রং দর্শকদের প্রভাবিত করে কিনা দেখা দরকার



রোলার কোস্টার যখন সবচেয়ে উপরে উঠবে, কেটে দিতে হবে বিদ্যুৎ সংযোগ উচ্চতাভীতি চুম্বনকে প্রলম্বিত করে



ইতিহাসের গায়ে লেগে আছে আমাদের কবরখানা প্রীতি, তাকে কম পাওয়ারের আলোয় পড়া যাক। উপনিবেশের ইতিহাস একটা সহস্রমাথা কাচের মিনার ছটফট করছে পতঙ্গ এমনকি আলোও ঢুকে বেরোতে পারছে না মৃদু কম্পনে বদলে যাচ্ছে আমাদের অন্বয়

এইখানে সবকিছু ছেড়ে দাও যা হয়েছে ভালোর জন্য, যা হবে তা-ও
বিকেল নরম হলে চলে এসো স্রোতহীন দীঘিটার পাড়ে
কাদার উপরে রাখো বালির পতাকা
শিরা ও বাক্যের মত রক্ত চলাচল জেনো সেটাও বালির
নক্ষত্র খচিত জলে ধুয়ে নাও সমস্ত পূর্বাপর

ছোট শহরগুলো থেকে পালিয়ে যাও
দম বন্ধ করে রাখা শিথিল রাস্তা
সমস্ত বর্ণনামুলকের গায়ে গজিয়ে ওঠা ঢোল কলমির গন্ধ
তোমাকে আবার পিচ্ছিল করছে
অথচ তুমি জানো সমস্ত শান্তিপূর্ণ গন্ধের পিছনে
কিছু সশস্ত্র লোক থেকে যায়
তুমি দেখেছো প্রকাশ্যে গুলি করা মৃতদেহ
তুমি স্বীকার করেছো ভারতবর্ষ শান্তির দেশ

তুমি ভেবেছো কেন সাংবাদিকতা ফেটে পড়ছে না এতদিনেও
শুধু গল্পের পর গল্প
ছোট শহরের ভাতের হোটেলে রাঁধা মাংসের স্বাদ
দাঁতের ফাঁকে নিয়ে তুমি ভাবছো
সমস্ত শহর নির্মিত হয়েছে
দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার পর

এখানেই মনে হয় ছোট শহর
নীচু বাড়িদের দেশ ও কাল
যেন সহজে বেরিয়ে ফিরে আসা যাবে অতি দ্রুত

বাড়ি শব্দটা বড় হয়ে ওঠে
বাড়ির ছায়া ও তাতে নিমগ্ন বেঁজি
সাপ খুঁজে পেয়েছে এই প্রবল শীতেও
মাটি গরম হয়ে উঠছে
আমরা বুঝতে চাইছি না
কুপিয়ে চলেছি ফসল ও প্রত্ন
কারা কবে এসে ফেলে গেছে তাদের পুরনো উনুনের ঝিঁক
খুঁজে পাচ্ছি শীতল সমস্ত ঈশ্বরমূর্তি উপাসনা
ধুলো মাখা পাথর

যেমন এই পৌষের দখিনা বাতাস ও খয়েরি রং
সিমেন্ট ও বালির অনুপাত
জল ও ইঁটের নাম
মিশে যাচ্ছে স্মৃতির সঙ্গে শেষ হয়ে যাওয়া
আবেগ ও বাড়ির গন্ধ
উঁচু হয়ে থাকা বেয়াড়া উপমায়

তুমি জানো এই দুনিয়ার আর কিস্যু হবার নেই
কবির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জাগে
যেখানে ভাষা ও অন্ধকার সমার্থক
যেখানে হালকা হয়ে আসা মাথার যন্ত্রণায়
শিশুর চিৎকার লেগে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় কাগজের স্তূপ
তোমার না-লেখা তুমি জানো
নেশা তাড়িত মাথা ক্রমাগত ভুল দেখায়
ডুবে যায় সহজ হয়ে আসা রাত্তিরে
কেন তুমি আলাদা হয়ে যাও
একজন তাড়া খাওয়া মানুষ আচমকা ফিসফিস করে ওঠে
ছাই হয়ে থাকা হাতের আঙুল কোন দিকে ইশারা করে?

যেন আচমকা থেকে গেছে চারপাশ
তোমার সামনে এক অনন্তকাল শেষ না হওয়া দাবার ম্যাচ

যেন আচমকা তুমি তৈরি করেছো
কাল্পনিক একটা শহর
সমতল বা পাহাড়
অসমর্পিত একটা চারণভূমি জুড়ে নেমে আসছে নদী
কাদা ও পাথর ভাঙার শব্দে সচকিত হয়ে উঠছে রাত
মশাল ও অন্যান্য আগুনে
রুটি ও মাংসের গন্ধে তুমি টের পাচ্ছো সংঘর্ষ বিরতি
যাকে রাত বলে ডাকা হয়ে থাকে

No comments

FACEBOOK COMMENT